দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা বা মব সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। গত ১০ মাসে মবের শিকার হয়ে ও গণপিটুনিতে সারাদেশে ১৭৪ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে গতকাল সোমবার পর্যন্ত মারা গেছেন ৮৩ জন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এই হিসাবের মতো পৃথক হিসাব দিয়েছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনও (এমএসএফ)। তাদের হিসাবে গত ৮ মাসে এ ধরনের ঘটনায় মারা গেছেন অন্তত ১৫০ জন। আহত হয়েছেন ৩৬৩ জন। নভেম্বর ও ডিসেম্বর হিসাব তাদের ওয়েবসাইটে নেই।
এমএসএফের হিসাবে ২০২৩ সালে এ ধরনের ১৪৩টি ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৮৬ জন।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, একের পর এক মবের ঘটনা ঘটলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। সরকারের বিবৃতি ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণার পরও মব চলছে।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও একাধিকবার মবের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। খোদ পুলিশ সদস্যরা এখনও মবের শিকার হচ্ছেন। আসামি ছাড়িয়ে নেওয়া ও বেআইনি দাবিতে থানা ও পুলিশের যানবাহন ঘেরাও, হামলা করা হচ্ছে। গত ১০ মাসে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ৪৭৭টি মামলা হয়েছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৪ সালের আগস্টে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪১টি, সেপ্টেম্বরে ২৪, অক্টোবরে ৩৪, নভেম্বরে ৪৯, ডিসেম্বরে ৪৪, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৮, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭, মার্চে ৯৬, এপ্রিলে ৫২ ও মে মাসে ৬২টি। এই পরিসংখ্যান বলছে, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা বাড়ছে।
সর্বশেষ রোববার উত্তরায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার বাসায় মবের ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। তবে পুলিশ কয়েকজনকে শনাক্ত করেছে বলে জানিয়েছে।
ভয়-ভীতি দেখিয়ে নূরুল হুদা ছাড়াও সাবেক দুই প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে রোববার দুপুরে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করে বিএনপি। মামলা দায়েরের কয়েক ঘণ্টা পর মব সৃষ্টি করে নূরুল হুদাকে হেনস্তা করে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক দলের কিছু নেতাকর্মীর যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
নুরুল হুদার দারোয়ান ফেরদৌস হাসান বলেন-রোববার সন্ধ্যা ৬টার দিকে ৪০-৪৫ জনের একটি দল গেট খোলা পেয়ে অতর্কিতভাবে বাসায় ঢুকে পড়ে। তারা স্যারকে বলেন, আপনার নামে মামলা হয়েছে, আমরা আপনার নিরাপত্তা দিতে এসেছি। এই বলে স্যারকে জোরপূর্বক টেনেহিঁচড়ে নিচে নামিয়ে আনে।
ইউনুসের ক্ষমতায় এতদিন পরও মব সন্ত্রাস বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেই।দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। এর দায় সরকার এড়াতে পারে না। এসব ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, কে মবের শিকার হবে, কারা হামলা চালাবে, কে মামলা করবে, কে ভিডিও করবে– সব যেন পরিকল্পিত। তবে মব হলো সংক্রামক ব্যাধির মতো। এখনই এটাকে দমন করা না গেলে এমন পরিস্থিতির শিকার যে কেউ হতে পারেন।
নূরুল হুদার বাসায় যারা মব সৃষ্টি করেছিলেন, তাদের কয়েকজনকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে আছেন– উত্তরা পশ্চিম থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব মো. হানিফ, থানা যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক তোহা ইসলাম মুন্না, থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা মোজাম্মেল হক ঢালী ও কাইয়ুম। নূরুল হুদার গলায় জুতা পরিয়ে গালে জুতা মারেন মোজাম্মেল হক ঢালী।
কেএম নূরুল হুদাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজের দৃশ্য শুধু একজন ব্যক্তির প্রতি নয়, বরং দেশের সংবিধান, মানবাধিকারের ন্যূনতম মূল্যবোধ ও আইনের শাসনের প্রতি সরাসরি আঘাতের নামান্তর।
সরকারের নীরবতা সহিংস গোষ্ঠীগুলোর অপকর্মে প্রভাব জোগাচ্ছে
মানবাধিকার সংগঠন আসক এক বিবৃতিতে বলেছে, কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা নিষ্পত্তির একমাত্র পথ সংবিধান ও আইনি প্রক্রিয়া। বিচার ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে যে কোনো অপমানজনক ও সহিংস আচরণ শুধু ব্যক্তি-অধিকারই লঙ্ঘন করে না, তা একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আসক বলেছে, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনায় কমপক্ষে ৮৩ জন মানুষ নিহত হয়েছেন, যা একটি সভ্য রাষ্ট্রে ঘোরতর নৈরাজ্যের ইঙ্গিত বহন করে।