বা্ংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল এই মর্মে একটি সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে বলে মাস দুই আগে ‘দ্য ওয়াল’-এ লেখা হয়েছিল।
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের (liberation war of Bangladesh) মুক্তিযোদ্ধার (Muktiyodhhya) তালিকায় মঙ্গলবার রাতে বড় ধরনের পরিবর্তন করা হল। সরকারি অধ্যাদেশ জারি করে বলা হল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (Sheikh Mujibur Rahaman), তাজউদ্দীনের (Tajuddin) মতো স্বাধীনতা যুদ্ধের সেনানিরা আর বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে বিবেচিত হবেন না। তাঁদের বলা হবে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী শক্তি (Collabprator of liberation war)।
বা্ংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল এই মর্মে একটি সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে বলে মাস দুই আগে ‘দ্য ওয়াল’-এ লেখা হয়েছিল। মঙ্গলবার রাতে রাষ্ট্রপতির অনুমতিক্রমে মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল অধ্যাদেশ ২০২৫ জারি করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। অধ্যাদেশের ফলে শেখ মুজিবুর রহমান-সহ প্রায় চারশো এমএনএ (জাতীয় পরিষদের সদস্য) ও এমপিএ (প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য) বীর মুক্তিযোদ্ধা থেকে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসাবে গন্য হবেন।
এঁরা হলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে যুক্ত ১৯৭০ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী যাঁরা গণপরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন। নয়া অধ্যাদেশ অনুযায়ী অস্ত্র হাতে ময়দানে যুদ্ধ করেছেন যাঁরা তাঁরাই শুধু মুক্তিযোদ্ধা বলে গন্য হবেন। সেই অনুযায়ী বিএনপি-র প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর মুক্তিযোদ্ধা বিবেচিত হবেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন একটি সেক্টরের কমান্ডার।
মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে মুজিব স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার অল্পকিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি সেনা তাঁকে গ্রেফতার করে। পরদিন নিয়ে যায় করাচিতে। পরের নয় মাস তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে বন্দি ছিলেন। অন্যদিক, তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলামের মতো নেতারা কলকাতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। তাঁরা সকলেই এতদিন বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে বিবেচিত হতেন।
অধ্যাদেশে মহম্মদ ইউনুসের সরকার মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছে। এক. যেসব বাংলাদেশি পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রাখেন এবং বাংলাদেশের যেসব নাগরিক বিশ্বজনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। দুই. যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত, মুজিবনগর সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিন. মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত সব এমএনএ বা এমপিএ, যাঁরা পরবর্তী সময়ে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন। চার. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সব বাংলাদেশি সাংবাদিক। পাঁচ. স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
অনেকেই মনে করছেন, নয়া মানদণ্ড অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীর তালিকায় বহু নতুন নাম অম্তর্ভুক্ত করা হবে। তাঁদের অন্যতম হল মহম্মদ ইউনুস। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে ছিলেন না। এমনকী দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও স্বাধীনতা যুদ্ধ বিষয়ক কোনও কিছুর সঙ্গেই তাঁর সম্পৃক্তকার প্রমাণ মেলেনি। এমন ঢাকার শহিদ মিনাক, সাভারের জাতীয় স্মতিসৌধও প্রথম পরিদর্শন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পর। এই সব বিষয় আলোচনায় আসার পর তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে দাবি করা হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বিদেশে অর্থ সংগ্রহের কাজ করেছেন। তিনি সেই সময় পড়াশুনোর জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ প্রশাসনের অনেকেই মনে করছেন, তালিকাটি এমনভাবে সংশোধন করা হয়েছে, যাতে প্রথম তালিকায় প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস ও তাঁর মতো আরও অনেককে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুর সমতুল করে তোলা যায়। গত বছর ৫ অগাস্টের পর থেকে বাংলাদেশে শেখ মুজিবর রহমানের অবদানকে অস্বীকার, তাঁর স্মৃতিকে মুছে ফেলার যে ধারাবাহিক প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে তার ধারাবাহিকতায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকাও সংশোধন করে ফেলা হল।
অধ্যাদেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাঁরা দেশের ভেতরে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, তৎকালীন মুসলিম লিগ, জামায়াতে ইসলামি, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, এরূপ সব বেসামরিক নাগরিক বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন। পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ বাহিনী, মুক্তিবাহিনী, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) ও সেই সরকার স্বীকৃত অন্যান্য বাহিনী, নৌ কমান্ডো, আনসার সদস্যরাও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন।